সনেট নিয়ে অনেকের অনেক রকম চিন্তা। কেউ কেউ সনেট লিখতে আগ্রহী হলেও এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত পরিমাণে জ্ঞান না থাকায় তারা লিখতে পারছেন না।
কেউ কেউ আবার লিখতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। আমার এই পোস্টটি তাদের জন্য।
সর্বপ্রথম চলুন সনেট এর পরিচয় জেনে নিই।
সনেট পরিচিতি:
সনেটের জন্ম ইতালিতে। ইতালীয় শব্দ sonetto (sound-piece তথা ধনীখণ্ড) থেকে সনেটের নামকরণ করা হয়েছে।
ইতালীয় ভাষাতেই সনেটের বেড়ে ওঠা।
Dante Alighieri (১২৬৫-১৩২১ খ্রিঃ), Cino da Pistoia (১২৬৫-১৩৩৬), Francesco Petrarca (১৩০৪-১৩৭৪), Giovanni Boccacio (১৩১৩-১৩৭৫), Tarquato Tasso (১৫০৪-৯৫) প্রমুখ কবিগণ সনেটকে বিশ্বসাহিত্যে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা দান করেন।ইতালীয় ভাষায় পেত্রার্কার হাতেই সনেট পূর্ণতা লাভ করে। পরবর্তীতে অন্যান্য ভাষায় সনেট রচিত হলে পেত্রার্কার রীতিই অনুসৃত হতে থাকে, যা থেকে কবিগণ নিজস্ব স্বকীয়তা দ্বারা নিজ নিজ রীতির উদ্ভাবন করত তাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
আমাদের বাংলায় সনেটের প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি সনেটের বাংলা প্রতিশব্দ দেন "চতুর্দশপদী কবিতা"
অর্থাৎ যে কবিতায় চোদ্দটি পঙ্ক্তি (লাইন) থাকবে।তিনি এ দ্বারা ১৪ পঙ্ক্তি বোঝাতেন, কিন্তু অনেক ছন্দবিজ্ঞানী এ-দ্বারা পঙ্ক্তির 'পদ' বা ছন্দ-পর্ব বুঝতেন। 'চতুর্দশপদী' কথাটা দ্ব্যর্থবোধক হওয়ায় সনেটের প্রতিশব্দ হিসেবে বহুল প্রচলিত হতে পারে নি।
আদি ইতালীয় সনেটের দু'টি ভাগ থাকে।
প্রথম ভাগে আট পঙ্ক্তি এবং দ্বিতীয় ভাগে আট পঙ্ক্তি।
প্রথম অংশটিকে অষ্টক এবং দ্বিতীয় অংশটিকে ষটক বলা হয়। সাধারণত অষ্টকটি দুটি এক-প্রকার মিলযুক্ত চৌপদিকা বা চতুষ্ক যোগে গঠিত। ষটকে দুই বা তিন প্রকার ভিন্নতর অন্ত্যমিল বিভিন্নভাবে ব্যবস্থিত হয়ে থাকে। কোনো কোনো সনেটের ষটক একটি চতুষ্ক ও অন্তিমে একটি শ্লোক থাকতে পারে; কিংবা ষটকের শুরু হয় একটি সমিল শ্লোক এবং শেষ হয় একটি চৌপদিকা দ্বারা। ১৬ পঙ্ক্তির সনেটও লেখা হয়েছিল, তার সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য এবং তা অসমাদৃত।
সনেটের কনসেপ্ট:
আদি ইতালীয় সনেটের অষ্টকে ও ষটকে যথাক্রমে ভাবের আবর্তন ও নিবর্তন বিধৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ অষ্টকে যেকোন একটি ভাব প্রকাশ এবং ষটকে সেই ভাবের সমাপ্তি হয়ে থাকে। অষ্টকে যে বক্তব্যের পরিবেশনা, ষটকে তার পরিপূরক রূপ অথবা বিপরীত দিক অঙ্কন করে পরিশেষে আবেগের উপসংহার করা হয়। খাঁটি সনেটের আদর্শ রূপবন্ধন সম্বন্ধে স্বনামখ্যাত ইংরেজ কবি ও সমালোচক Theodore Watts-Dunton (১৮৩২-১৯১৪) বলেছেন :
সমুদ্রতরঙ্গের উচ্ছ্বাস ও পতন যেমন তাল-লয় ব্যবচ্ছিন্ন, সনেটের ভাবতরঙ্গের উচ্ছ্বাস ও পতনও সেরূপ তাল-লয় ব্যবচ্ছিন্ন। ফেনিলোচ্ছল সাগরতরঙ্গ যেমন ক্রমশ স্ফীত ও বর্ধিতকায় হয়ে বেলাভূমির উপর উৎপতিত হয়, এবং নিমেষমাত্র স্থির থেকে আবার উজান বেগে সাগরগর্ভে অপসারিত হয়, সেরূপ ভাবের তরঙ্গ ছন্দোময়ী শব্দধারায় অষ্টকে উচ্ছলিত হয়ে বিপরীত আবর্তনে ষটকে অবসানপ্রাপ্ত হয়।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে: অষ্টকের শুরুতে একটি ভাব প্রকাশ হয়ে তা বিস্তৃতি লাভ করতে থাকবে যা অষ্টকের শেষে গিয়ে চুড়ান্ত রূপ ধারণ করবে।
অতঃপর ষটকে সেই ভাব ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।
এবং ষটকের শেষে ভাবের সমাপ্তি ঘটবে।
অষ্টক এবং ষটক কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
অষ্টকের প্রথম চার লাইনে থাকে ভাবের উত্থাপন তথা ভাবের সূচনা।
দ্বিতীয় চার লাইনে থাকবে ভাবের (বিষয়ের) বর্ণনা।
ষটকের প্রথম তিন লাইনে ভাবের পূর্ণতা বা সেই ভাব সম্পর্কে চুড়ান্ত মতামত এবং শেষ তিন লাইনে সমাপ্তি। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ভাবের একটা মীমাংসা।
কখনো কখনো এই ভাগের মিলবন্ধন ও দেখা যায়।
অষ্টকের প্রথম ভাগ থেকে দ্বিতীয় ভাগে, ষটকের প্রথম ভাগ থেকে দ্বিতীয় ভাগে। অথবা অষ্টকের ভাব ষটকে যেতেও দেখা যায় তবে সেটা উচিত নয়।
অষ্টকের ভাগদ্বয়ের মধ্যে যেমন ভিতর থেকে মিল থাকেনা তেমনি ষটকের ভাগদ্বয়ের মধ্যেও কোন আন্তসম্পর্ক থাকে না।
কবিগন তাদের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে তাকে কয়েক ভাগ করে বিভিন্ন পাশ থেকে ভাবটা উত্থাপন করেন।
চলবে...
(তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট)
Social Plugin